টাকি ভ্রমণ – দ্বিতীয় পর্ব
টাকি ভ্রমণ – দ্বিতীয় পর্ব
টাকি ভ্রমণ গাইড – টাকি তে দেখার কি কি আছে?
টাকি ভ্রমণের দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে আজ হাজির হলাম। প্রথম পর্বে আমরা জেনেছি টাকি কোথায় অবস্থিত, টাকি কি জন্যে এত জনপ্রিয়, টাকি কিভাবে যাবো, কোথায় থাকবো ইত্যাদি।
প্রথম পর্বে টাকির সেরা কিছু গেস্ট হাউসের নাম ও ফোন আপনাদের দিয়েছি। সেই সাথে দিয়েছি শিয়ালদহ — হাসনাবাদ লোকাল এর টাইম টেবিল। আজকের পর্বে টাকির দ্রষ্টব্য স্থানগুলির দিকে আলোকপাত করবো।
প্রথম পর্বের লিঙ্ক
শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ উত্তর ২৪ পরগনার টাকি শহর। এই শহর জুড়ে রয়েছে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান। তবে সেই সব জায়গাগুলো পর্যটকেরা যাতে একদিনে ঘুরে দেখতে পারেন সেই কথা মাথায় রেখে টাকি পৌরসভা অবশ্য দ্রষ্টব্য স্থানের একটি তালিকা তৈরি করেছে। টাকি রোড স্টেশনের বাইরে বেরোতেই আপনার চোখে পড়বে সেই তালিকা। সেই তালিকা অনুযায়ী টাকির অবশ্য দ্রষ্টব্য দশটি জায়গা হলো……
১ টাকি রাজবাড়ি ঘাট
২ গোল পাতার জঙ্গল (মিনি সুন্দরবন)
৩ তিন নদীর মোহনা
৪ জোড়া শিব মন্দির
৫ মেজর জেনারেল শংকর রায়চৌধুরীর বাড়ি
৬ বিসর্জন সিনেমার শ্যুটিং স্পট
৭ কুলেশ্বরী কালীবাড়ি
৮ ঘোষ বাড়ির দুর্গা দালান
৯ পূবের বাড়ি
১০ টাকি রামকৃষ্ণ মিশন
আগেই বলেছি কলকাতা থেকে টাকি যাবার সেরা উপায় হলো শিয়ালদহ থেকে হাসনাবাদ লোকাল ধরে টাকি রোড স্টেশন পৌঁছানো। চেষ্টা করবেন সকাল ৬\১২ বা ৭\৪০ এর ট্রেন ধরার। তাহলে সাড়ে আটটা থেকে দশটার মধ্যে পৌঁছে যাবেন টাকি। টাকি রোড স্টেশনে নেমে ফেরার টিকিট করে রাখুন অথবা শিয়ালদহ থেকেই আপ ও ডাউন দুটো টিকিটই কেটে নেবেন। এতে সময় কিছুটা বাঁচবে।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে টোটো পেয়ে যাবেন, দর দাম করে সারাদিনের জন্য বুক করে নিন। মোটামুটি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পড়বে সবকটি স্পট দেখার জন্য। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, দুপুরের লাঞ্চ করার জন্য অতিরিক্ত সময়ের কথাটা টোটোওয়ালাকে প্রথমেই বলে নেবেন যাতে তার জন্য পরে অতিরিক্ত টাকা দাবি না করে। আর লাঞ্চ এর জন্য টোটোওয়ালারা তাদের পরিচিত স্থানে নিয়ে যান, তাই এই ব্যাপারটাও মাথায় রাখবেন। রাজবাড়ি ঘাটের আশেপাশে অনেক ভালো ভালো রেস্তোরাঁ পেয়ে যাবেন যেখানে আপনি মধ্যাহ্নভোজ সারতে পারবেন।
এছাড়াও স্টেশন থেকে টোটো নিয়ে চলে আসতে পারেন টাকি রাজবাড়ি ঘাটে। সেখানে টোটো স্ট্যান্ড থেকে টোটো রিজার্ভ করে নিন।
এবার আসি দ্রষ্টব্য স্থানের কথায়। ওই যে বলেছি তালিকার কথা, স্টেশনের বাইরে টাঙ্গানো আছে, পারলে তার একটা ছবি তুলে নেবেন। যাতে লিস্ট মিলিয়ে সবকটি জায়গা দেখে নিতে পারেন,কিছু বাদ না পড়ে। আমি তো সেটাই করেছিলাম।
স্টেশন থেকে বেরোতে একজন টোটো চালক ভাই আমাদের দিকে এগিয়ে এসে কোথায় যাবো জানতে চাইলো। ওনার গাড়ি আমরা সারাদিনের জন্য রিজার্ভ করে নিই। আমরা চারজন ছিলাম। আমাদের টোটো ভাড়া পড়েছিলো ৬০০ টাকা।
টাকি রামকৃষ্ণ মিশন
টোটো চালক ভাই আমাদের নিয়ে রওনা হলো। মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ যেতেই চলে এলাম আমাদের প্রথম দ্রষ্টব্যে। টাকি রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম। সবুজ রঙের গ্রিল এর গেট খুলে ভিতরে ঢুকে গেলাম। ঝকঝকে পরিষ্কার আশ্রম প্রাঙ্গণের ডানদিকে স্কুল আর বাদিকে মিশনের অফিস ঘর। আর গেটের একদম সোজাসুজি প্রার্থনা গৃহ।প্রবেশ পথের দুপাশ শীতের বাহারি ফুলগাছে সাজানো। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলার বারো ভূঁইয়ার
বংশধর শ্রী অজিত রায় চৌধুরী মহাশয় তাঁর টাকির এই বাসভবনে রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেন।
কুলেশ্বরী কালীবাড়ি
রামকৃষ্ণ মিশন দেখে আবার চড়ে বসলাম টোটোতে।দ্বিতীয় দ্রষ্টব্য কুলেশ্বরী কালীবাড়ি।ছিমছাম গ্রাম্য পরিবেশের মাঝে মন্দিরটির অবস্থান। প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো হলেও দেখে কিন্তু বোঝার উপায় নেই।সংস্কারের প্রলেপে প্রাচীন মন্দিরে লেগেছে নতুনের ছোঁয়া।এই মন্দিরের ইতিহাস শোনালেন টোটো ভাই। একদা টাকির রাজা মানসিংহ ইচ্ছামতী নদীর তীরে প্রথমবার কালী পুজো করেন। পুজো সম্পন্ন হবার পর খুব স্বাভাবিক ভাবেই পুজোর সামগ্রী, মায়ের প্রতিমা নদীতে বিসর্জন করা হয়। কিন্তু দেখা যায় যে সবকিছু নদীবক্ষে বিসর্জিত হলেও পুজোর ঘটটি নদীতে ভাসতে থাকে। এর কিছুদিনের মধ্যেই টাকির তৎকালীন জমিদারকে মা কালী স্বপ্নাদেশ দেন যে তিনি যেনো মায়ের পুজোর ঘটটি নদী থেকে তুলে প্রতিষ্ঠা করেন ও নিয়মিত পুজো করেন। জমিদারমশাই তখন লোক লাগিয়ে ইছামতী নদীর কূল থেকে ঘটটি তুলে এনে এই মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেই থেকে ওই ঘট এখানে পুজো হয়ে আসছে। যদিও তার পাশে মায়ের মৃণ্ময়ী মূর্তিও পুজিত হয়। নন্দীর কূলে ঘটটি পাওয়া গিয়েছিলো বলে মা কালী এখানে কূলেশ্বরী মা নামে পরিচিত হোন, আর এই মন্দির কূলেশ্বরী কালীবাড়ি নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠে।
প্রতি বছর কৃষ্ণ একাদশীতে মায়ের অঙ্গে পরে নতুন রঙের প্রলেপ। কালী পুজোর রাতে ও প্রতি অমাবস্যায় মায়ের বিশেষ পুজো হয় এখানে। কিন্তু যেটা শুনে খুব খারাপ লাগলো যে প্রতি পুজো তে প্রথা মেনে হয় ছাগবলি। প্রতি বছর দুর্গা অষ্টমীতে হয় কুমারী পুজো যা কূলেশ্বরী কালীবাড়ির একটি বিশেষত্ব বলা যেতে পারে।
পূবের বাড়ি
কূলেশ্বরী মায়ের দর্শন সেরে এবার এগিয়ে চললাম টাকি শহরের প্রাণ কেন্দ্র টাকি রাজবাড়ি ঘাটের দিকে। টাকি শহরের ব্যস্ত জীবন, দোকান, বাজার, স্কুল, কলেজ সব কিছু প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম। বেশ সুন্দর সেই অভিজ্ঞতা। পথেই পড়লো আর এক দ্রষ্টব্য টাকি পূবের বাড়ি। ৩০০ বছরেরও বেশী পুরোনো এই জমিদার বাড়ি। টাকিতে কিন্তু বেশ কিছু পুরোনো জমিদার বাড়ি আছে, এটি তার মধ্যে একটি। শহরের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত হওয়ার কারণে এই জমিদার বাড়ির নাম পূবের বাড়ি। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সুপ্রাচীন এই জমিদার বাড়ি আজ ভগ্নপ্রায়।
এই জমিদার বাড়ির বর্তমান প্রজন্মের কেউই এখানে থাকেন না, তাই বাড়ির সিংহ দুয়ার বন্ধ থাকে সারা বছর।কিন্তু এখনো প্রতি বছর এই বাড়িতে দুর্গা পুজো হয়। তখন বাড়ির দরজা জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। আর পুজোর চারটি দিন পূবের বাড়ি তার একাকীত্ব ও নীরবতা কাটিয়ে আলো ঝলমলে উৎসব মুখর হয়ে ওঠে।
টাকি রাজবাড়ি ঘাট
টাকি শহরের প্রাণকেন্দ্র তথা সবথেকে সুন্দর জায়গা টাকি রাজবাড়ি ঘাট। শুধু সুন্দর বললে কম বলা হবে, এই ঘাটের সাথে জড়িয়ে আছে বাঙালির আবেগ। কেননা এই সেই বিখ্যাত ঘাট যেখানে প্রতি বছর বিজয়া দশমীর দিন এসে পৌঁছায় পুত্র কন্যা সহ একের পর এক দুর্গা প্রতিমা। এই ঘাটেই হয় এপার বাংলার প্রতিমা বিসর্জন। আর ইছামতীর জলে ওপার বাংলার প্রতিমা বিসর্জন দেখার জন্য ভিড় জমাতে হবে এই রাজবাড়ি ঘাটেই ।
আমাদের টোটো চালক ভাই কিন্ত রাজবাড়ি ঘাট যাবার আগে আমাদের মধ্যাহ্নভোজের ব্যাবস্থাটা সেরে নেওয়ার পরামর্শ দিলো, আমরাও সম্মতি দিলাম। সেই কথা মতো আমাদের নিয়ে গেলো টাকি পৌরসভার গেস্ট হাউসে। গেস্ট হাউসের অতিথি ছাড়াও ওনাদের রেস্টুরেন্টে যে কেউ খেতে পারেন। তবে সেটা ঘণ্টাখানেক আগে জানিয়ে দিলেই ভালো হয়। আমরা কে কি খাবো তা লিখিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলাম। ওখানে মিল সিস্টেম পাওয়া যায়। সবজি মিল, মাছের মিল, চিকেন মিল , এগ মিল সবই মিলবে।
টাকি পৌরসভার এই গেস্ট হাউসের সামনেই বয়ে চলেছে ইছামতী। নদীর পাড় খুব সুন্দর করে বাঁধানো। রয়েছে অনেক বসার বেঞ্চ। একটি ওয়াচ টাওয়ারও আছে, সেখান থেকে হয়তো নদীর ওপারে প্রতিবেশী দেশের দিকে নজর রাখা হয়। নদীর পাড় পাঁচিল ঘেরা। সেই পাঁচিল ধরে দাঁড়িয়ে ওপারে বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে কেটে গেলো অনেকটা সময়। চোখে পড়লো নদীর বুকে ভেসে চলছে দুই বাংলার নৌকা। হাওয়ায় পত পত করে উড়তে থাকা দুই দেশের পতাকা জানান দেয় তাদের পরিচয়।
অতিথিশালার সামনের রাস্তা সোজা চলে গেছে টাকি রাজবাড়ি ঘাটের দিকে।
টাকি রাজবাড়ি ঘাটের আশেপাশে রয়েছে থাকার জন্য বেশ কিছু হোটেল ও গেস্ট হাউস। টাকিতে একটি দিন থাকতে চাইলে এই গেস্ট হাউসগুলির মধ্যে একটি তে থাকাই সবথেকে ভালো, কারন রাজবাড়ি ঘাটের সামনেই রয়েছে টোটো স্ট্যান্ড। এখান থেকে টোটো রিজার্ভ করে ঘুরে দেখতে পারবেন শহরটা। থাকার গেস্ট হাউস ছাড়াও পাবেন ছোট বড় অনেক খাওয়ার হোটেল।
টাকির রাজবাড়ি ঘাট ঠিক যেনো এক সুসজ্জিত পার্কের মতো। সেই পার্কের ভিতরে হাঁটা যায়, বসা যায়, জমিয়ে আড্ডা দেয়া যায় ঘন্টার পর ঘন্টা।সন্ধ্যে হলে এই ঘাটে জ্বলে ওঠে আলোর রোশনাই। ইছামতীর জলে সেই আলোর প্রতিফলন বড়ই মায়াবী তখন। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে যেনো মেলা বসে যায় এই চত্বরে। ফুচকা, ঝালমুড়ি, চাট ইত্যাদি সব স্ট্রিট ফুড এর মেলা।
শতাব্দী প্রাচীন এই ঘাটের ইতিহাস জানলাম স্থানীয় মানুষদের থেকে। একসময় এই জায়গায় ছিল টাকির জমিদার বাড়ি, যাকে স্থানীয় মানুষেরা রাজবাড়ি বলতেন। কালের নিয়মে হারিয়ে গেছে সেই রাজবাড়ি। কিছু ধ্বংসাবশেষ অবশ্য এখনো আছে। সেই প্রাচীন রাজবাড়ির স্মৃতি রক্ষার্থে তৈরী হয়েছে এই রাজবাড়ি ঘাট। এখানে এসে সত্যিই মন ভোরে গেলো।
মেজর জেনারেল শংকর রায়চৌধুরীর বাড়ি
মন ভোরে টাকির রাজবাড়ি ঘাটের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। অনেক ছবি তুললাম। বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে আবার আমরা টোটো তে চড়ে বসলাম। একদিনের ভ্রমণে এসেছি তাই হাতে সময় কম। এবড়ো খেবড়ো মাটির রাস্তা আবার কখনো বা পাকা রাস্তা….এভাবে চলতে লাগলো আমাদের সওয়ারী। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পৌঁছলাম একটি তিনতলা বাড়ির সামনে। পুরোনো দিনের বাড়ি হলেও বেশ well maintained. দুধ সাদা বাড়িটি দেখে মনে হলো যেনো শৃঙ্খলা ও সৌর্যের প্রতীক। কারন বাড়িটি যে আমাদের দেশের প্রাক্তন মেজর জেনারেল শংকর রায় চৌধুরীর বাড়ি। এই বাড়িটি ওনার জন্মভিটে। ওঁনার বাল্যকাল কেটেছে এই বাড়িতেই। স্থানীয়দের কাছে এই বাড়ি যে কতটা গর্বের তা তাদের কথা থেকেই বেশ বুঝতে পারলাম।
বাড়িটি এর পিছনের অংশে রয়েছে দুর্গা দালান। পুরোনো হলেও বেশ ঝাঁ চকচকে। শুনলাম মাঝে মাঝে নাকি বিভিন্ন সিনেমা ও সিরিয়াল এর শ্যুটিং হয়ে থাকে এই বাড়িতে।
গাছপালায় ঘেরা মেজর জেনারেল এর এই বাড়িতে এক অদ্ভুত শান্তির বাতাবরণ বিরাজ করছে।কত অজানা ইতিহাসের সাক্ষী এই বাড়ি। বেশ কিছুটা সময় এখানে কাটিয়ে,মনের মধ্যে এক শান্তির অনুভূতি সঞ্চয় করে আবার এগিয়ে চললাম পরবর্তী দ্রষ্টব্যের দিকে।
বিসর্জন সিনেমার শ্যুটিং স্পট
আবার কিছুটা পথ টোটো চড়া, তারপরেই পৌঁছে গেলাম একটা আটপৌরে সাদামাটা মাটির বাড়ির সামনে। চিনতে পারছেন বাড়ি টা?” চালক ভাইয়ের প্রশ্ন স্মরণ করিয়ে দিলো আরে এ তো সেই বাড়ি, যার দাওয়ায় বসে সুখ দুঃখের কথা বলতো পদ্মা আর নাসির। চোখের সামনে ভেসে উঠল বিসর্জন সিনেমার টুকরো টুকরো দৃশ্য।
পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় তার জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত চলচ্চিত্র বিসর্জন এর সিংহভাগ শ্যুটিং এই বাড়িতেই হয়েছিলো। সেই থেকে এই সাদামাটা মাটির বাড়িটি বিখ্যাত ও একটি দ্রষ্টব্যস্থান হয়ে উঠেছে।
এই বিসর্জন বাড়ির চারপাশের গ্রাম্য পরিবেশ, পুকুর, গাছপালা, প্রশস্ত উঠোন সবকিছুই আমাদের মন কেড়ে নিলো। উঠোনের একপাশে দেখলাম মধুর চাষ হচ্ছে, যাকে বলে Apiary.
জোড়া শিব মন্দির
বিসর্জন বাড়ি দেখা শেষ হলো যখন ঘড়িতে তখন বাজে সাড়ে বারোটা। চালক ভাই পরামর্শ দিলেন এবার মধ্যাহ্নভোজ সেরে ফেলার। আমরাও সুবোধ বালকের মতো সম্মতি জানিয়ে টোটোতে চেপে পড়লাম। খাবার তো অর্ডার করাই ছিলো, সুতরাং আর চিন্তা নেই।
যেতে যেতে পথে পড়লো একটা বেশ বড় পুকুর আর পুকুরের ধারে এক জোড়া মন্দির। এই হলো টাকির বিখ্যাত জোড়া শিব মন্দির। ভাবলে অবাক লাগে যে এই মন্দিরদ্বয় তিনশো বছরেরও বেশি পুরোনো। টাকি পৌরসভার নব সংস্করণ এর কৃপায় মন্দির দুটি নবীন রূপে সুসজ্জিত হয়েছে।
মন্দিরের পরিবেশ একেবারে শান্ত নিরিবিলি। টলটলে দিঘীর জলের উপর ঠান্ডা হাওয়া আলপনা এঁকে চলেছে।
প্রতি বছর শিবরাত্রির দিন নাকি অসংখ্য ভক্ত সমাগম হয় এখানে। মেলাও বসে।
শুধু তাই নয়, পাওলি দাম ও দেব অভিনীত বাংলা সিনেমা ‘ সাঝঁবাতি ‘ এর প্রধান শ্যুটিং স্থল ছিল এই জোড়া শিব মন্দির।
এই পর্যন্ত ঘোরাঘুরি সেরে আমরা গেলাম টাকি পৌরসভার গেস্ট হাউস নীপেন্দ্র অতিথিশালায়।সেরে নিলাম মধ্যাহ্নভোজ।
গোল পাতার জঙ্গল ( মিনি সুন্দরবন)
ভাবুন তো একবার, টাকি ভ্রমণে এসে যদি পান সুন্দরবনের আস্বাদন, কেমন হবে তাহলে ? বেশ রোমাঞ্চকর তাই না ?
টাকির সবথেকে বড় আকর্ষণ হলো গোল পাতার জঙ্গল যা কিনা মিনি সুন্দরবন নামে বেশি পরিচিত। এখানে এসে জানলাম গোলপাতা নাম হলেও এই গাছের পাতার আকার লম্বাকৃতির। গোল পাতার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কংক্রিটের বাঁধানো সাঁকো ( ক্যানোপি ওয়াক ) চলে গিয়েছে ইচ্ছামতির পাড়ের দিকে। শুধু গোলপাতার গাছ নয়, সাঁকো ধরে যেতে যেতে দেখা পেলাম হোগলা, সুন্দরী, গরাণ, কেওড়ার মতো অসংখ্য মূল্যবান গাছের। জঙ্গল পেরোতেই ইছামতি নদীতট , মাঝে আছে একটি বিশ্রামের জায়গা। নদী এখানে একটু সংকীর্ণ, তাই প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশকে এখান থেকে আরো ভালোভাবে দেখা যায়।
২০১২ সালে টাকি পৌরসভা দ্বারা পরিচালিত এই মিনি সুন্দরবনের উদ্বোধন হয়। জঙ্গলে ঢোকার মুখে পড়বে টিকিট কাউন্টার। টিকিটের মুল্য মাথাপিছু দশ টাকা।
টিকিট কেটে গোল পাতার জঙ্গল যাবার পথে চোখে পড়লো স্থানীয় মহিলারা পাটালী গুড়, ঝোলা গুড়ের হাঁড়ি সাজিয়ে বসেছেন বিক্রি করার জন্য। দাম একটু কম, মান কিন্তু ভালো।তাই ফেরার পথে বাড়ির জন্য কিনে নিলাম খানিক গুড়। এছাড়া বসিরহাটের বিখ্যাত গামছাও মিলবে এই স্থানে।
ঘোষ বাড়ির দুর্গা দালান
আনুমানিক ৩৫১বছর আগে এই বাড়ীতে বৈষ্ণব মতে দুর্গাপূজা শুরু করেন জমিদার হরি নারায়ণ ঘোষ।বর্তমানে এই ঘোষ জমিদারদের দূর্গা দালান ঝোপ জঙ্গলে ঘেরা এক ভুতুড়েবাড়ীতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তা স্বত্বেও এই পাঁচ খিলানের দূর্গা দালানটি আজও জানান দিচ্ছে সেই যুগের জমিদার বংশের অর্থ ও প্রতিপত্তির।
ভগ্নপ্রায় এই জমিদার বাড়িটি মাঝে মাঝে সিনেমার শুটিং এর জন্য ব্যবহার করা হয়। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় অভিনীত শঙ্খচিল সিনেমার প্রধান শুটিং স্পট ছিল এই ঘোষ বাড়ির দুর্গা দালান।
তিন নদীর মোহনা
সকাল থেকে ঘুরে বেড়ালাম টাকি শহরের নানা প্রান্তে। দেখলাম সবকটি দ্রষ্টব্য। মনের মাঝে তখন নানা বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা। ঘুরতে ঘুরতে বেশ কিছুটা ক্লান্ত পথিক আমরা শেষ বেলায় এসে পৌঁছলাম এমন একটি জায়গায় যেখানে গিয়ে ক্লান্ত শরীর আবার যেনো তরতাজা হয়ে উঠলো।
বেলা শেষের অস্তমিত রবি যখন দিগন্তে রক্তিম আভা ছাড়িয়ে বিদায় নেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে ঠিক সেই সময়ে আমরা গিয়ে পৌঁছলাম আমাদের শেষ দ্রষ্টব্য তিন নদীর মহোনায়।
এখানে যাবার রাস্তাটিও বেশ সুন্দর ।একের পর এক ইট ভাটার মধ্যে দিয়ে নিয়ে গেলো আমাদের টোটো। শেষ ইট ভাটাএ এসে টোটো থামালেন চালক, বাকি পথটা যে হেঁটে যেতে হবে। এবরো খেবরো মাটির রাস্তা ধরে একটু এগোতেই পৌঁছে গেলাম মোহনার কাছে। একসাথে তিন নদীর মিলন ঘটেছে এখানে। ইছামতী, বিদ্যাধরী ও কালিন্দী। শান্ত নদী ত্রয়ীতে তখন ভাটার টান। কি ধীর গতিতে বয়ে চলেছে তিন সুন্দরী। সেই শান্ত পরিবেশ আর মিষ্টি হাওয়ার মন সিক্ত হয়ে গেলো।
স্থানীয় মানুষদের কাছে জানলাম কালিন্দী নদী চলে গেছে সুন্দরবনের দিকে। তাইতো টাকিকে ‘গেটওয়ে অফ সুন্দরবন’ বলা হয়। এখনে এসে চোখে পড়লো নদিবক্ষে দুই প্রান্তের বেশ কিছু নৌকা ও লঞ্চ। গোধূলির মিঠে আলোয় দুই দেশের মানুষের জলবিহারের দৃশ্য বড়ই মনোমুগ্ধকর। ওপারে বাংলাদেশ এপারে ভারত, মাঝখানে ইছামতী বয়ে চলে যায়।
তিন নদীর মোহনায় চোখে পড়লো কয়েকজন পাহারারত বি এস এফ জওয়ান। আর দেখলাম ইট তৈরীর জন্য মেশিন দিয়ে তোলা হচ্ছে নদীর তীরে জমে থাকা পলি। এবার যে ফেরার পালা। তাই সব সুন্দরকে দুচোখে বন্দী করে আমরা ফিরে গেলাম টোটোতে।
এর সাথেই শেষ হলো আমাদের একদিনের টাকি ভ্রমণ। একদিনের এই সফর মনে থাকবে চিরদিন। তাহলে বন্ধুরা একবার অবশ্যই ঘুরে আসুন…..